Tuesday, 11 June 2019

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ----- আমি

আমি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে ।
আমি চোখ মেললুম আকাশে -----
জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে ।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ' সুন্দর ' ,
সুন্দর হল সে ।

তুমি বলবে এ যে তত্ত্বকথা , এ কবির বাণী নয় ।
আমি বলব , এ সত্য ,
তাই এ কাব্য ।
এ আমার অহংকার ------
অহংকার সমস্ত মানুষের হয়ে ।
মানুষের অহংকার-পটেই
বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প ।
তত্ত্বজ্ঞানী জপ করছেন নিশ্বাসে প্রশ্বাসে -----
না , না , না ----
না পান্না , না চুনি , না আলো , না গোলাপ ,
না আমি , না তুমি ।
ও দিকে , অসীম যিনি তিনি স্বয়ং করছেন সাধনা
মানুষের সীমানায় , 
তাকেই বলে ' আমি ' ।
সেই আমির গহনে আলো-আঁধারের ঘটল সংগম ,
দেখা দিল রূপ , জেগে উঠল রস ।
' না ' কখন ফুটে উঠে হল ' হাঁ ' , মায়ার মন্ত্রে ,
রেখায় রঙে , সুখে দুঃখে ।।

একে বোলো না তত্ত্ব ;
আমার মন হয়েছে পুলকিত
বিশ্ব- আমির রচনার আসরে
হাতে নিয়ে তুলি , পাত্রে নিয়ে রঙ ।।

পন্ডিত বলছেন ------
বুড়ো চন্দ্রটা , নিষ্ঠুর চতুর হাসি তার ,
মৃত্যুদূতের মত গুঁড়ি মেরে আসছে সে
পৃথিবীর পাঁজরের কাছে ।
একদিন দেবে চরম টান তার সাগরে পর্বতে ;
মর্তলোকে মহাকালের নূতন খাতায়
পাতা জুড়ে নামবে একটা শূন্য ,
গিলে ফেলবে দিনরাতের জমাখরচ ;
মানুষের কীর্তি হারাবে কমরতার ভান ,
তার ইতিহাসে লেপে দেবে
অনন্ত রাত্রির কালি ।
মানুষের যাবার দিনের চোখ
বিশ্ব থেকে নিকিয়ে নেবে রঙ ,
মানুষের যাবার দিনের মন
ছানিয়ে নেবে রস ।
শক্তির কম্পন চলবে আকাশে আকাশে ,
জ্বলবে না কোথাও আলো ।
বীণাহীন সভায় যন্ত্রীর আঙুল নাচবে ,
বাজবে না সুর ।
সেদিন কবিত্বহীন বিধাতা একা রবেন বসে
নীলিমাহীন আকাশে
ব্যক্তিত্বহারা অস্তিত্বের গনিততত্ত্ব নিয়ে ।
তখন বিরাট বিশ্বভুবনে
দূরে দূরান্তে অনন্ত অসংখ্যলোকে লোকান্তরে
এ বাণী ধ্বনিত হবে না কোনোখানেই -------
' তুমি সুন্দর '
' আমি ভালোবাসি ' ।
বিধাতা কি আবার বসবেন সাধনা করতে
যুগযুগান্তর ধরে ?
প্রলয়সন্ধ্যায় জপ করবেন ------
' কথা কও , কথা কও ' ,
বলবেন ' বলো , তুমি সুন্দর ' ,
বলবেন ' বলো , আমি ভালোবাসি ' ?

No comments:

Post a Comment