Monday 4 February 2019

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা - বীরপুরুষ

বীরপুরুষ

মনে করো , যেন বিদেশ ঘুরে

মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে ।
তুমি যাচ্ছ , পালকিতে , মা , চ'ড়ে
দরজাদুটো একটুকু ফাঁক করে ,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার 'পরে
টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে ।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
রাঙা ধুলোর মেঘ উড়িয়ে আসে ।।



সন্ধ্যে হল , সূর্য নামে পাটে ,

এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে ।
ধূধূ করে যেদিক পানে চাই ,
কোনোদিকে জনমানব নাই ,
তুমি যেন আপন মনে তাই
ভয় পেয়েছ --- ভাবছ ' এলেম কোথা ' ?
আমি বলছি , ' ভয় কোরো না মাগো ,
ওই দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা । '



চোরকাঁটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে ,

মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে ।
গরুবাছুর নেইকো কোনোখানে ,
সন্ধ্যে হতেই গেছে গায়ের পানে ,
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে ---
অন্ধকারে দেখা যায়না ভালো ,
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে ,
' দিঘির ধারে ওই যে কিসের আলো ' ?



এমন সময় হাঁরে রে রে রে রে '

ওই যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে ।
তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোনে
ঠাকুর দেবতা স্মরণ করছ মনে ,
বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে
পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরোথরো ।
আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে ,
' আমি আছি , ভয় কেন মা করো ! '



হাতে লাঠি , মাথায় ঝাঁকড়া চুল ,

কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল ।
আমি বলি , ' দাঁড়া , খবরদার !
এক পা কাছে আসিস যদি আর !
এই চেয়ে দেখ্ আমার তলোয়ার
টুকরো করে দেব তোদের সেরে । '
শুনে তারা লম্ফ দিয়ে উঠে
চেঁচিয়ে উঠল ' হারে - রে - রে - রে - রে ' ।



তুমি বললে , ' যাসনে খোকা ওরে । '

আমি বলি , ' দেখো না চুপ করে ' ।
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে ,
ঢাল তলোয়ার ঝনঝনিয়ে বাজে --
কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে
শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে ,
কত লোকের মাথা পড়ল কাটা ।



এত লোকের সঙ্গে লড়াই করে

ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে ।
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে ,
বলছি এসে , ' লড়াই গেছে থেমে ।'
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে
চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে --
বলছ , ' ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল !
কী দুর্দশাই হত তা না হলে । '



রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা

এমন কেন সত্যি হয়না , আহা ।
ঠিক যেন এক গল্প হত তবে ,
শুনত যারা অবাক হত সবে ।
দাদা বলত , ' কেমন করে হবে ,
খোকার গায়ে এত কি জোর আছে । '
পাড়ার লোকে সবাই বলত শুনে ,
' ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের কাছে । '

No comments:

Post a Comment