Monday 16 December 2019

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা --- নিরুদ্দেশ যাত্রা

নিরুদ্দেশ যাত্রা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে
হে সুন্দরী ?
বলো , কোন পার ভিড়িবে তোমার
সোনার তরী ।
যখনি শুধাই , ওগো বিদেশিনী ,
তুমি হাসো শুধু , মধুরহাসিনী ---
বুঝিতে না পারি , কী জানি কী আছে
তোমার মনে ।
নীরবে দেখাও অঙ্গুলি তুলি
অকূল সিন্ধু উঠিছে আকুলি ,
দূরে পচিমে ডুবিছে তপন
গগনকোনে ।
কী আছে হোথায় --- চলেছি কিসের 
অন্বেষণে ?

বলো দেখি মোরে , শুধাই তোমায়
অপরিচিতা ---
ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কূলে
দিনের চিতা ,
ঝলিতেছে জল তরল অনল ,
গলিয়া পড়িছে অম্বরতল ,
দিকবধূ যেন ছলছল আঁখি
অশ্রুজলে ,
হোথায় কি আছে আলয় তোমার
ঊর্মিমুখর সাগরের পার
মেঘচুম্বিত অস্তগিরির
চরণতলে ?
তুমি হাসো শুধু মুখপানে চেয়ে
কথা না বলে ।

হূহূ করে বায়ু ফেলিছে সতত
দীর্ঘশ্বাস ।
অন্ধ আবেগে করে গর্জন 
জলোচ্ছ্বাস ।
সংশয়ময় ঘননীল নীর ,
কোনোদিকে চেয়ে নাহি হেরি তীর ,
অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া
দুলিছে যেন ।
তারি পরে ভাসে তরনী হিরণ ,
তারি পরে পড়ে সন্ধ্যাকিরণ ,
তারি মাঝে বসি এ নীরব হাসি
হাসিছ কেন ?
আমি তো বুঝিনা কী লাগি তোমার
বিলাস হেন ।

যখন প্রথম ডেকেছিলে তুমি
' কে যাবে সাথে '
চাহিনু বারেক তোমার নয়নে
নবীন প্রাতে ।
দেখালে সমুখে প্রসারিয়া কর
পশ্চিমপানে অসীম সাগর ,
চঞ্চল আলো আশার মতন
কাঁপিছে জলে ।
তরীতে উঠিয়া শুধানু তখন
আছে কি হোথায় নবীন জীবন ,
আশার স্বপন ফলে কি হোথায়
সোনার ফলে ?
মুখপানে চেয়ে হাসিলে কেবল
কথা না বলে ।

তারপরে কভু উঠিয়াছে মেঘ
কখনো রবি ---
কখনো ক্ষুব্ধ সাগর কখনো
শান্তছবি ।
বেলা বয়ে যায় , পালে লাগে বায় ----
সোনার তরনী কোথা চলে যায় ,
পশ্চিমে হেরি নামিছে তপন
অস্তাচলে
এখন বারেক শুধাই তোমায় ,
স্নিগ্ধ মরণ আছে কি হোথায় , 
আছে কি শান্তি , আছে কি সুপ্তি
তিমিরতলে ?
হাসিতেছ তুমি তুলিয়া নয়ন
কথা না বলে ।

আঁধার রজনী আসিবে এখনি
মেলিয়া পাখা ,
সন্ধ্যা-আকাশে স্বর্ণ- আলোক
পড়িবে ঢাকা ।
শুধু ভাসে তব দেহসৌরভ ,
গায়ে উড়ে পড়ে বায়ুভরে তব
কেশের রাশি ।
বিকল হৃদয় বিবশ শরীর
ডাকিয়া তোমারে কহিব অধীর ,
' কোথা আছো , ওগো , করহ পরশ
নিকটে আসি ।'
কহিবে না কথা , দেখিতে পাব না
নীরব হাসি ।

No comments:

Post a Comment