Thursday, 4 April 2019

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা --- আফ্রিকা

আফ্রিকা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

উদভ্রান্ত সেই আদিম যুগে

স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে
নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত ,
তাঁর সেই অধৈর্যে ঘন-ঘন মাথা নাড়ার দিনে
রুদ্র সমুদ্রের বাহু
প্রাচী ধরিত্রীর বুকের থেকে
ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে , আফ্রিকা ---
বাঁধলে তোমাকে বনস্পতির নিবিড় পাহারায়
কৃপণ আলোর অন্তঃপুরে ।
সেখানে নিভৃত অবকাশে তুমি
সংগ্রহ করছিলে দুর্গমের রহস্য ,
চিনছিলে জলস্থল- আকাশের দুর্বোধ সংকেত ,
প্রকৃতির দৃষ্টি-অতীত জাদু
মন্ত্র জাগাচ্ছিল , তোমার চেতনাতীত মনে ।
বিদ্রূপ করছিলে ভীষণকে
বিরূপের ছদ্মবেশে ,
শঙ্কাকে চাচ্ছিলে হার মানাতে
আপনাকে উগ্র ক'রে বিভীষিকার প্রচন্ড মহিমায়
তান্ডবের দুন্দুভি নিনাদে ।।

হায় ছায়াবৃতা ,

কালো ঘোমটার নীচে
অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ
উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে ।
এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে ,
নখ যাদের তীক্ষ্ম তোমার নেকড়ের চেয়ে ,
এল মানুষ-ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে ।
সভ্যের বর্বর লোভ
নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা ।
তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকুল অরণ্যপথে
পঙ্কিল হলো ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে ,
দস্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায়
বীভৎস কাদার পিন্ড
চিরচিহ্ণ দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে ।।

সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই তাদের পাড়ায় পাড়ায়

মন্দিরে বাজছিল পূজার ঘন্টা
সকালে সন্ধ্যায় দয়াময় দেবতার নামে ;
শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে ;
কবির সংগীতে বেজে উঠেছিল
সুন্দরের আনাগোনা ।।

আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে

প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রূদ্ধশ্বাস ,
যখন গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল ---
অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিমকাল ,
এসো যুগান্তের কবি ,
আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে
দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে ;
বলো ' ক্ষমা করো ' ----
হিংস্র প্রলাপের মধ্যে
সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী ।।

No comments:

Post a Comment