Tuesday 23 April 2019

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা --- খেলাভোলা

খেলাভোলা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তুই কি ভাবিস দিন রাত্তির
খেলতে আমার মন ?
কক্ষনো তা সত্যি না মা ,
আমার কথা শোন ।

সেদিন ভোরে দেখি উঠে
বৃষ্টি বাদল গেছে ছুটে ,
রোদ উঠেছে ঝিলমিলিয়ে
বাঁশের ডালে ডালে ।

ছুটির দিনে কেমন সুরে
পুজোর সানাই বাজছে দূরে ,
তিনটি শালিক ঝগড়া করে
রান্নাঘরের চালে ।

খেলনাগুলো সামনে মেলি
কিযে খেলি , কি যে খেলি ,
সেই কথাটাই সমস্তক্ষণ
ভাবনু আপন মনে ।

লাগল না ঠিক কোনো খেলাই
কেটে গেল সারা বেলাই ---
রেলিং ধরে রইনু বসে
বারান্দাটার কোনে ।।

খেলাভোলার দিন মা ,
আমার আসে মাঝে মাঝে ---
সেদিন আমার মনের ভিতর
কেমনতর বাজে ।

শীতের বেলায় দুই পহরে
দূরে কাদের ছাদের পরে
ছোট্ট মেয়ে রোদ্দুরে দেয়
বেগনি রঙের শাড়ি ।

চেয়ে চেয়ে চুপ করে রই ,
তেপান্তরের পার বুঝি ওই ---
মনে ভাবি ওইখানেতেই
আছে রাজার বাড়ি  ।

থাকত যদি মেঘে ওড়া
পক্ষীরাজের বাচ্ছা ঘোড়া ,
তক্ষুনি যে যেতেম তারে
লাগাম দিয়ে কষে ।

যেতে যেতে নদীর তীরে
ব্যঙ্গমা আর ব্যঙ্গমীরে।
পথ শুধিয়ে নিতেম আমি
গাছের তলায় বসে।।

এক এক দিন যে দেখেছি
তুই বাবার চিঠি হাতে
চুপ করে কী ভাবিস বসে
ঠেস দিয়ে জানালাতে।

মনে হয় তোর মুখ চেয়ে
তুই যেন কোন দেশের মেয়ে,
যেন আমার অনেক কালের
অনেক দূরের মা।

কাছে গিয়ে হাতখানি ছুই
হারিয়ে যাওয়া মা যেন তুই,
মাঠ পারে কোন বটের তলায়
বাঁশির সুরের মা।

খেলার কথা যায় যে ভেসে,
মনে ভাবি কোন কালে সে
কোন দেশে তোর বাড়ি ছিল
কোন সাগরের কুলে।

ফিরে যেতে ইচ্ছে করে
অজানা সেই দ্বীপের ঘরে
তোমায় আমায় ভোর ‌বেলাতে
নৌকোতে পাল তুলে।।

Saturday 20 April 2019

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা --- আগমন

আগমন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তখন রাত্রি আঁধার হল , সাঙ্গ হল কাজ ---

আমরা মনে ভেবেছিলেম , আসবে না কেউ আজ ।
মোদের গ্রামে দুয়ার যত     রূদ্ধ হল রাতের মতো ---
দুয়েকজনে বলেছিল , ' আসবে মহারাজ  ' ।
আমরা হেসে বলেছিলাম , ' আসবে না কেউ আজ ' ।

দ্বারে যেন আঘাত হল শুনেছিলেম সবে ---

আমরা তখন বলেছিলেম , ' বাতাস বুঝি হবে ' ।
নিবিয়ে প্রদীপ ঘরে ঘরে    শুয়েছিলেম আলসভরে ----
দুয়েকজনে বলেছিল , ' দূত এল বা তবে । '
আমরা হেসে বলেছিলেম , ' বাতাস বুঝি হবে ।'

নিশীথ রাতে শোনা গেল কিসের যেন ধ্বনি ---

ঘুমের ঘোরে ভেবেছিলেম মেঘের গরজনি ।
ক্ষণে ক্ষণে চেতন করি      কাঁপল ধরা থরহরি ---
দুয়েকজনে বলেছিল , ' চাকার ঝনঝনি ' ।
ঘুমের ঘরে কহি মোরা ' মেঘের গরজনি ' ।

তখনো রাত আঁধার আছে , বেজে উঠল ভেরী ---

কে ফুকারে ' জাগো সবাই , আর কোরো না দেরি । '
বক্ষ'পরে দুহাত চেপে     আমরা ভয়ে উঠি কেঁপে ,
দুয়েক জনে কহে কানে , ' রাজার ধ্বজা হেরি । '
আমরা জেগে উঠে বলি , ' আর তবে নয় দেরি । '

কোথায় আলো , কোথায় মালা , কোথায় আয়োজন !

রাজা আমার দেশে এল , কোথায় সিংহাসন !
হায় রে ভাগ্য , হায় রে লজ্জা --- কোথায় সভা কোথায় সজ্জা !
দুয়েক জনে কহে কানে , ' বৃথা এ ক্রন্দন , 
রিক্তকরে শূণ্য ঘরে করো অভ্যর্থন ।'
ওরে , দুয়ার খুলে দে রে , বাজা শঙ্খ বাজা ---
গভীর রাতে এসেছে আজ আঁধার ঘরের রাজা ।
বজ্র ডাকে শূণ্যতলে ,    বিদ্যুতেরই ঝিলিক ঝলে ,
ছিন্ন শয়ন টেনে এনে আঙিনা তোর সাজা ----
ঝড়ের সাথে হঠাৎ এল দুঃখ রাতের রাজা ।

Monday 8 April 2019

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা --- সুখদুঃখ

সুখদুঃখ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বসেছে আজ রথের তলায় 
স্নানযাত্রার মেলা ।
সকাল থেকে বাদল হল
ফুরিয়ে এল বেলা ।
আজকে দিনের মেলামেশা ,
যত খুশি , যতই নেশা ,
সবার চেয়ে আনন্দময়
ওই মেয়েটির হাসি ।
এক পয়সায় কিনেছে ও
তালপাতার এক বাঁশি ।
বাজে বাঁশি , পাতার বাঁশি
আনন্দস্বরে ।
হাজার লোকের হর্ষধ্বনি
সবার উপরে ।

ঠাকুরবাড়ি ঠেলাঠেলি
লোকের নাহি শেষ ।
অবিশ্রান্ত বৃষ্টিধারায়
ভেসে যায় রে দেশ ।
আজকে দিনের দুঃখ যত
নাই রে দুঃখ উহার মত
ওই যে ছেলে কাতর চোখে
দোকান-পানে চাহি ,
একটি রাঙা লাঠি কিনবে
একটি পয়সা নাহি ।
চেয়ে আছে নিমেষহারা,
নয়ন অরুণ ।
হাজার লোকের মেলাটিরে
করেছে করুণ ।

Thursday 4 April 2019

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা --- আফ্রিকা

আফ্রিকা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

উদভ্রান্ত সেই আদিম যুগে

স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে
নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত ,
তাঁর সেই অধৈর্যে ঘন-ঘন মাথা নাড়ার দিনে
রুদ্র সমুদ্রের বাহু
প্রাচী ধরিত্রীর বুকের থেকে
ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে , আফ্রিকা ---
বাঁধলে তোমাকে বনস্পতির নিবিড় পাহারায়
কৃপণ আলোর অন্তঃপুরে ।
সেখানে নিভৃত অবকাশে তুমি
সংগ্রহ করছিলে দুর্গমের রহস্য ,
চিনছিলে জলস্থল- আকাশের দুর্বোধ সংকেত ,
প্রকৃতির দৃষ্টি-অতীত জাদু
মন্ত্র জাগাচ্ছিল , তোমার চেতনাতীত মনে ।
বিদ্রূপ করছিলে ভীষণকে
বিরূপের ছদ্মবেশে ,
শঙ্কাকে চাচ্ছিলে হার মানাতে
আপনাকে উগ্র ক'রে বিভীষিকার প্রচন্ড মহিমায়
তান্ডবের দুন্দুভি নিনাদে ।।

হায় ছায়াবৃতা ,

কালো ঘোমটার নীচে
অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ
উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে ।
এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে ,
নখ যাদের তীক্ষ্ম তোমার নেকড়ের চেয়ে ,
এল মানুষ-ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে ।
সভ্যের বর্বর লোভ
নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা ।
তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকুল অরণ্যপথে
পঙ্কিল হলো ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে ,
দস্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায়
বীভৎস কাদার পিন্ড
চিরচিহ্ণ দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে ।।

সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই তাদের পাড়ায় পাড়ায়

মন্দিরে বাজছিল পূজার ঘন্টা
সকালে সন্ধ্যায় দয়াময় দেবতার নামে ;
শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে ;
কবির সংগীতে বেজে উঠেছিল
সুন্দরের আনাগোনা ।।

আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে

প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রূদ্ধশ্বাস ,
যখন গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল ---
অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিমকাল ,
এসো যুগান্তের কবি ,
আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে
দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে ;
বলো ' ক্ষমা করো ' ----
হিংস্র প্রলাপের মধ্যে
সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী ।।