Sunday, 17 May 2020

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা -- প্রাণ

প্রাণ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে ,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই ।
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই !
ধরায় প্রাণের খেলা চিরতরঙ্গিত ,
বিরহ মিলন কত হাসি -অশ্রু-ময় ----
মানবের সুখে দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত
যদি গো রচিতে পারি অমর- আলয় !
তা যদি না পারি , তবে বাঁচি যতকাল
তোমাদেরি মাঝখানে লভি যেন ঠাই ,
তোমরা তুলিবে বলে সকাল বিকাল
নব নব সংগীতের কুসুম ফুটাই ।
হাসিমুখে নিয়ো ফুল , তার পরে হায়
ফেলে দিয়ো ফুল , যদি সে ফুল শুকায় ।

Tuesday, 12 May 2020

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা --- কবির বয়স

কবির বয়স
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ওরে কবি , সন্ধ্যা হয়ে এল ,
কেশে তোমার ধরেছে যে পাক ---
বসে বসে উর্ধ্বপানে চেয়ে
শুনতেছ কি পরকালের ডাক ?
কবি কহে,সন্ধ্যা হল বটে,
শুনছি বসে লয়ে শ্রান্ত দেহ ,
এ পারে ওই পল্লীহতে যদি
আজো হঠা‌ৎ ডাকে আমায় কেহ।
যদি হোথায় বকুল-বনচ্ছায়ে
মিলন ঘটে তরুন-তরুণীতে ,
দুটি আঁখির পরে দুইটি আঁখি
মিলিতে চায় দুরন্ত সঙ্গীতে---
কে তাহাদের মনের কথা লয়ে
বীণার তারে তুলবে প্রতিধ্বনি
আমি যদি ভবের কূলে বসে
পরকালের ভালো-মন্দই গণি ?।

সন্ধ্যাতারা উঠে অস্তে গেল ,
চিতে নিবে গেল নদীর ধারে ,
কৃষ্ণপক্ষে হলুদবর্ণ চাঁদ
দেখা দিল বনের একটি পারে,
শৃগালসভা ডাকে উর্ধ্বরবে
পোড়ো বাড়ির শূণ্য আঙিনাতে-
এমন কালে কোনো গৃহত্যাগী
হেথায় যদি জাগতে আসে রাতে ,
জোড়হস্তে উর্ধ্বে তুলি মাথা
চেয়ে দেখে সপ্ত ঋষির পানে ,
প্রাণের কুলে আঘাত করে ধীরে
সুপ্তিসাগর শব্দবিহীন গানে ---
ত্রিভুবনের গোপন কথাখানি
কে জাগিয়ে তুলবে তাহার মনে
আমি যদি আমার মুক্তি নিয়ে
যুক্তি করি আপন গৃহকোণে ?।

কেশে আমার পাক ধরেছে বটে ,
তাহার পানে নজর এত কেন ?
পাড়ায় যত ছেলে এবং বুড়ো
সবার আমি একবয়সি জেনো ।
ওষ্ঠে কারো সরল সাদা হাসি
কারো হাসি আঁখির কোণে কোণে ,
কারো অশ্রু উছলে পড়ে যায়
কারো অশ্রু শুকায় মনে মনে ,
কেউ-বা থাকে ঘরের কোণে দোঁহে
জগৎ-মাঝে কেউ-বা হাঁকায় রথ ,
কেউ-বা মরে একলা ঘরের শোকে
জনারণ্যে কেউ-বা হারায় পথ ---
সবাই মোরে করেন ডাকাডাকি ,
কখন শুনি পরকালের ডাক ?
সবার আমি সমানবয়সি যে
চুলে আমার যত ধরুক পাক ।।

Saturday, 9 May 2020

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা --- দুঃসময়

দুঃসময়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে ,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া ,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে ,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া ,
মহা-আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে ,
দিক-দিগন্ত অবগুন্ঠনে ঢাকা ---
তবু বিহঙ্গ , ওরে বিহঙ্গ মোর ,
এখনি , অন্ধ , বন্ধ কোরো না পাখা ।।

এ নহে মুখর বনমর্মরগুঞ্জিত ,
এ যে অজাগর - গরজে সাগর ফুলিছে ।
এ নহে কুঞ্জ কুন্দকুসুমরঞ্জিত ,
ফেনহিল্লোল কলকল্লোলে দুলিছে ।
কোথা রে সে তীর ফুল পল্লবপুঞ্জিত ,
কোথা রে সে নীড় , কোথা আশ্রয় শাখা !
তবু বিহঙ্গ , ওরে বিহঙ্গ মোর ,
এখনি , অন্ধ , বন্ধ কোরো না পাখা ।।

এখনো সমুখে রয়েছে সুচির শর্বরী ,
ঘুমায় অরুণ সুদূর অস্ত- অচলে ।
বিশ্বজগৎ নিঃশ্বাসবায়ু সম্বরি
স্তব্ধ আসনে প্রহর গণিছে বিরলে ।
সবে দেখা দিল অকূল তিমির সন্তরি
দূর দিগন্তে ক্ষীণ শশাঙ্ক বাঁকা ।
ওরে বিহঙ্গ , ওরে ব্বিহঙ্গ মোর ,
এখনি , অন্ধ , বন্ধ কোরো না পাখা ।।

উর্ধ্ব আকাশে তারাগুলি মেলে অঙ্গুলি ,
ইঙ্গিত করি তোমা-পানে আছে চাহিয়া ।
নিম্নে গভীর অধীর মরণ উচ্ছলি
শত তরঙ্গে তোমা-পানে উঠে ধাইয়া ।
বহুদূর তীরে কারা ডাকে বাঁধি অঞ্জলি---
' এসো এসো ' সুর করুণ মিনতী-মাখা ।
ওরে বিহঙ্গ , ওরে বিহঙ্গ মোর ,
এখনি , অন্ধ , বন্ধ কোরো না পাখা ।।

ওরে ভয় নাই , নাই স্নেহমোহবন্ধন ---
ওরে আশা নাই , আশা শুধু মিছে ছলনা ।
ওরে ভাষা নাই , নাই বৃথা বসে ক্রন্দন ---
ওরে গৃহ নাই , নাই ফুলসেজ-রচনা ।
আছে শুধু পাখা , আছে মহানভ- অঙ্গন
উষা-দিশাহারা নিবিড়- তিমির -আঁকা ।
ওরে বিহঙ্গ , ওরে বিহঙ্গ মোর ,
এখনি , অন্ধ , বন্ধ কোরো না পাখা ।।

Sunday, 3 May 2020

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা--কৃপণ

কৃপণ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমি ভিক্ষা করে ফিরতেছিলেম গ্রামের পথে পথে,
তুমি তখন চলেছিলে তোমার স্বর্ণরথে ।
অপূর্ব এক স্বপ্নসম লাগতেছিল চক্ষে মম ---
কী বিচিত্র শোভা তোমার, কী বিচিত্র সাজ ।
আমি মনে ভাবতেছিলেম এ কোন্ মহারাজ ।।

আজি শুভক্ষণে রাত পোহালো, ভেবেছিলেম তবে
আজ আমারে দ্বারে দ্বারে ফিরতে নাহি হবে ।
বাহির হতে নাহি হতে কাহার দেখা পেলেম পথে ,
চলিতে রথ ধনধান্য ছড়াবে দুই ধারে ---
মুঠা মুঠা কুড়িয়ে নেব , নেব ভারে ভারে ।।

দেখি সহসা রথ থেমে গেল আমার কাছে এসে ,
আমার মুখ-পানে চেয়ে নামলে তুমি হেসে ।
দেখে মুখের প্রসন্নতা জুড়িয়ে গেল সকল ব্যথা ,
হেনকালে কিসের লাগি তুমি অকস্মাৎ
'আমায় কিছু দাও গো ' বলে বাড়িয়ে দিলে হাত ।।

মরি, এ কী কথা রাজাধিরাজ,' আমায় দাও গো কিছু ' -
শুনে ক্ষণকালের তরে রইনু মাথা - নিচু ।
তোমার কিবা অভাব আছে ভিখারি ভিক্ষুকের কাছে !
এ কেবল কৌতুকের বশে আমায় প্রবঞ্চনা ।
ঝুলি হতে দিলেম তুলে একটি ছোটো কণা ।।

যবে পাত্রখানি ঘরে এনে উজার করি ---- একি ,
ভিক্ষা-মাঝে একটি ছোটো সোনার কণা দেখি !
দিলেম যা রাজ-ভিখারিরে স্বর্ণ হয়ে এল ফিরে ---
তখন কাঁদি চোখের জলে দুটি নয়ন ভরে ,
তোমায় কেন দিইনি আমার সকল শূন্য করে ?।