Saturday 21 December 2019

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা --- আত্মসমর্পণ

আত্মসমর্পণ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তোমার আনন্দগানে আমি দিব সুর
যাহা জানি দু-একটি প্রীতিসুমধুর
অন্তরের ছন্দোগাথা ; দুঃখের ক্রন্দনে
বাজিবে আমার কন্ঠ বিষাদবিধুর
তোমার কন্ঠের সনে ; কুসুমে চন্দনে
তোমারে পূজিব আমি ; পরাব সিন্দূর
তোমার সীমান্তে ভালে ; বিচিত্র বন্ধনে
তোমারে বাঁধিব আমি , প্রমোদ সিন্ধুর
তরঙ্গেতে দিব দোলা নব ছন্দে তানে ।
মানব - আত্মার গর্ব আর নাহি মোর ,
চেয়ে তোর স্নিগ্ধশ্যাম মাতৃমুখ-পানে
ভালোবাসিয়াছি আমি ধূলিমাটি তোর ।
জন্মেছি যে মর্ত-কোলে ঘৃণা করি তারে
ছুটিব না স্বর্গ আর মুক্তি খুঁজিবারে ।

Thursday 19 December 2019

সুকুমার রায়ের কবিতা --- বোম্বাগড়ের রাজা

বোম্বাগড়ের রাজা
সুকুমার রায়


কেউ কি জানো সদাই কেন বোম্বাগড়ের রাজা ---
ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখে আমসত্ব ভাজা ?
রানীর মাথায় অষ্টপ্রহর কেন বালিশ বাঁধা ?
পাঁউরুটিতে পেরেক ঠোকে কেন রানীর দাদা ?
কেন সেথায় সর্দি হলে ডিগবাজি খায় লোকে ?
জোছনা রাতে সবাই কেন আলতা মাখায় চোখে ?
ওস্তাদেরা লেপ মুড়ি দেয় কেন মাথায় ঘাড়ে ?
টাকের পরে পডিতেরা ডাকের টিকিট মারে !
রাত্রে কেন ট্যাঁকঘড়িটা ডুবিয়ে রাখে ঘিয়ে ?
কেন রাজার বিছনা পাতে শিরীষ কাগজ দিয়ে ?
সভায় কেন চেঁচায় রাজা ' হুক্কা হুয়া ' বলে ?
মন্ত্রী কেন কলসি বাজায় বসে রাজার কোলে ?
সিংহাসনে ঝোলায় কেন ভাঙা বোতল শিশি ?
কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসি ?
রাজার খুড়ো নাচেন কেন হুঁকোর মালা পরে ?
এমন কেন ঘটছে তা কেউ বলতে পারো মোরে ?

Tuesday 17 December 2019

সুকুমার রায়ের কবিতা --- ঠিকানা

ঠিকানা
সুকুমার রায়

আরে আরে জগমোহন --- এসো , এসো , এসো ---
বলতে পারো কোথায় থাকে আদ্যানাথের মেশো ?
আদ্যানাথের নাম শোনোনি ? খগেনকে তো চেনো?
শ্যাম বাগচি খগেনেরই মামাশ্বশুর জেনো ।
শ্যামের জামাই কেষ্টমোহন , তার যে বাড়িওয়ালা --
( কি যেন নাম ভুলে গেছি ) তারই মামার শালা ;
তারই পিশের খুরতুতো ভাই আদ্যানাথের মেশো --
লক্ষ্মীদাদা , ঠিকানা তার একটু জেনে এসো ।
ঠিকানা চাও ? বলছি শোন ; আমড়াতলার মোড়ে
তিন-মুখো তিন রাস্তা গেছে তারি একটা ধরে ,
চলবে সিধে নাকবরাবর , ডানদিকে চোখ রেখে ;
চলতে চলতে দেখবে শেষে রাস্তা গিয়েছে বেঁকে ।
দেখবে সেথায় ডাইনে বাঁয়ে পথ গিয়েছে কত ,
তারি ভিতর ঘুরবে খানিক গোলোকধাঁধার মত ।
তার পরেতে হঠাৎ বেঁকে ডাইনে মোচর মেরে ,
ফিরবে আবার বাঁয়ের দিকে তিনটে গলি ছেড়ে ।তবেই আবার পড়বে এসে আমড়াতলার মোড়ে ---
তারপরে যাও যেথায় খুশি -- জ্বালিয়োনাকো মোরে।

Monday 16 December 2019

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা --- নিরুদ্দেশ যাত্রা

নিরুদ্দেশ যাত্রা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে
হে সুন্দরী ?
বলো , কোন পার ভিড়িবে তোমার
সোনার তরী ।
যখনি শুধাই , ওগো বিদেশিনী ,
তুমি হাসো শুধু , মধুরহাসিনী ---
বুঝিতে না পারি , কী জানি কী আছে
তোমার মনে ।
নীরবে দেখাও অঙ্গুলি তুলি
অকূল সিন্ধু উঠিছে আকুলি ,
দূরে পচিমে ডুবিছে তপন
গগনকোনে ।
কী আছে হোথায় --- চলেছি কিসের 
অন্বেষণে ?

বলো দেখি মোরে , শুধাই তোমায়
অপরিচিতা ---
ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কূলে
দিনের চিতা ,
ঝলিতেছে জল তরল অনল ,
গলিয়া পড়িছে অম্বরতল ,
দিকবধূ যেন ছলছল আঁখি
অশ্রুজলে ,
হোথায় কি আছে আলয় তোমার
ঊর্মিমুখর সাগরের পার
মেঘচুম্বিত অস্তগিরির
চরণতলে ?
তুমি হাসো শুধু মুখপানে চেয়ে
কথা না বলে ।

হূহূ করে বায়ু ফেলিছে সতত
দীর্ঘশ্বাস ।
অন্ধ আবেগে করে গর্জন 
জলোচ্ছ্বাস ।
সংশয়ময় ঘননীল নীর ,
কোনোদিকে চেয়ে নাহি হেরি তীর ,
অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া
দুলিছে যেন ।
তারি পরে ভাসে তরনী হিরণ ,
তারি পরে পড়ে সন্ধ্যাকিরণ ,
তারি মাঝে বসি এ নীরব হাসি
হাসিছ কেন ?
আমি তো বুঝিনা কী লাগি তোমার
বিলাস হেন ।

যখন প্রথম ডেকেছিলে তুমি
' কে যাবে সাথে '
চাহিনু বারেক তোমার নয়নে
নবীন প্রাতে ।
দেখালে সমুখে প্রসারিয়া কর
পশ্চিমপানে অসীম সাগর ,
চঞ্চল আলো আশার মতন
কাঁপিছে জলে ।
তরীতে উঠিয়া শুধানু তখন
আছে কি হোথায় নবীন জীবন ,
আশার স্বপন ফলে কি হোথায়
সোনার ফলে ?
মুখপানে চেয়ে হাসিলে কেবল
কথা না বলে ।

তারপরে কভু উঠিয়াছে মেঘ
কখনো রবি ---
কখনো ক্ষুব্ধ সাগর কখনো
শান্তছবি ।
বেলা বয়ে যায় , পালে লাগে বায় ----
সোনার তরনী কোথা চলে যায় ,
পশ্চিমে হেরি নামিছে তপন
অস্তাচলে
এখন বারেক শুধাই তোমায় ,
স্নিগ্ধ মরণ আছে কি হোথায় , 
আছে কি শান্তি , আছে কি সুপ্তি
তিমিরতলে ?
হাসিতেছ তুমি তুলিয়া নয়ন
কথা না বলে ।

আঁধার রজনী আসিবে এখনি
মেলিয়া পাখা ,
সন্ধ্যা-আকাশে স্বর্ণ- আলোক
পড়িবে ঢাকা ।
শুধু ভাসে তব দেহসৌরভ ,
গায়ে উড়ে পড়ে বায়ুভরে তব
কেশের রাশি ।
বিকল হৃদয় বিবশ শরীর
ডাকিয়া তোমারে কহিব অধীর ,
' কোথা আছো , ওগো , করহ পরশ
নিকটে আসি ।'
কহিবে না কথা , দেখিতে পাব না
নীরব হাসি ।