Saturday, 30 March 2019

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা --- দেবতার বিদায়

দেবতার বিদায়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

দেবতামন্দিরমাঝে ভকত প্রবীণ
জপিতেছে জপমালা বসি নিশিদিন।
হেনকালে সন্ধ্যাবেলা ধুলিমাখা দেহে
বস্ত্রহীন জীর্ণ দীন পশিল সে গেহে।
কহিল কাতরকণ্ঠে "গৃহ মোর নাই
এক পাশে দয়া করে দেহো মোরে ঠাঁই।"
সসংকোচে ভক্তবর কহিলেন তারে,
"আরে আরে অপবিত্র, দূর হয়ে যারে।"
সে কহিল, "চলিলাম"--চক্ষের নিমেষে
ভিখারি ধরিল মূর্তি দেবতার বেশে।

ভক্ত কহে, "প্রভু, মোরে কী ছল ছলিলে!"
দেবতা কহিল, "মোরে দূর করি দিলে।
জগতে দরিদ্ররূপে ফিরি দয়াতরে,
গৃহহীনে গৃহ দিলে আমি থাকি ঘরে।"



Thursday, 28 March 2019

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা -- হারিয়ে-যাওয়া

হারিয়ে-যাওয়া
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ছোট্ট আমার মেয়ে
সঙ্গিনীদের ডাক শুনতে পেয়ে
সিঁড়ি দিয়ে নিচের তলায় যাচ্ছিল সে নেমে
অন্ধকারে ভয়ে ভয়ে , থেমে থেমে।
হাতে ছিল প্রদীপখানি,
আঁচল দিয়ে আড়াল করে চলছিল সাবধানী।


আমি ছিলাম ছাতে
তারায়-ভরা চৈত্রমাসের রাতে।
হঠাৎ মেয়ের কান্না শুনে উঠে
দেখতে গেলেম ছুটে।
সিঁড়ির মধ্যে যেতে যেতে
প্রদীপটা তার নিভে গেছে বাতাসেতে।
শুধাই তারে, “কী হয়েছে বামী ?”
সে কেঁদে কয় নিচে থেকে, “হারিয়ে গেছি আমি।”


তারায় ভরা চৈত্রমাসের রাতে
ফিরে গিয়ে ছাতে
মনে হল আকাশ-পানে চেয়ে
আমার বামীর মতোই যেন অমনি কে এক মেয়ে
নীলাম্বরের আঁচলখানি ঘিরে
দীপশিখাটি বাঁচিয়ে একা চলছে ধীরে ধীরে।
নিবত যদি আলো, যদি হঠাৎ যেত থামি
আকাশ ভরে উঠত কেঁদে, “হারিয়ে গেছি আমি।”

Monday, 25 March 2019

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা --- হঠাৎ দেখা

হঠাৎ দেখা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা , 

ভাবিনি সম্ভব হবে কোনদিন ।।

আগে ওকে বারবার দেখেছি 

লাল রঙের শাড়িতে --
দালিম-ফুলের মত রাঙা;
আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,
আঁচল তুলেছে মাথায় 
দোলন-চাঁপার মত চিকন-গৌর মুখখানি ঘিরে ।
মনে হল , কালো রঙের একটা গভীর দূরত্ব
ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে,
যে দূরত্ব সর্ষেক্ষেতের শেষ সীমানায়
শালবনের নীলাঞ্জনে ।
থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা 
চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে ।।


হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে 

আমাকে করলে নমস্কার ।
সমাজবিধির পথ গেল খুলে ‌
আলাপ করলেম শুরু --
'কেমন আছো', 'কেমন চলছে সংসার ' 
ইত্যাদি ।
সে রইল জানালার বাইরের দিকে চেয়ে 
যেন কাছের-দিনের ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে ।
দিলে অত্যন্ত ছোটো দুটো-একটা জবাব ,
কোনটা বা দিলেই না ।
বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায় --
কেন এ-সব কথা ,
এর চেয়ে অনেক ভাল চুপ ক'রে থাকা ।।


আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে ওর সাথিদের সঙ্গে ।

এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে ।
মনে হল কম সাহস নয় --
বসলুম ওর এক বেঞ্চিতে ।
গাড়ির আওয়াজের আড়ালে 
বললে মৃদুস্বরে ,
'কিছু মনে কোরো না ,
সময় কোথা সময় নষ্ট করবার !
আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই ;
দূরে যাবে তুমি ,
দেখা হবে না আর কোনোদিনই ।
তাই, যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে ,
শুনব তোমার মুখে ।
সত্য করে বলবে তো ?'
আমি বললাম ,'বলব' ।
বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল,
'আমাদের গেছে যে দিন 
একেবারেই কি গেছে --
কিছুই কি নেই বাকি?'

একটুকু রইলেম চুপ করে ;

তার পর বললেম ,
'রাতের সব তারাই আছে 
দিনের আলোর গভীরে' ।

খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম নাকি ।

ও বললে, 'থাক এখন যাও ও দিকে' 
সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে ।
আমি চললেম একা ।। 

Wednesday, 20 March 2019

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা --- দুই পাখি

দুই পাখি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

খাঁচার পাখি ছিল     সোনার খাঁচাটিতে
             বনের পাখি ছিল বনে।
একদা কী করিয়া     মিলন হল দোঁহে,
        কী ছিল বিধাতার মনে।
বনের পাখি বলে,  খাঁচার পাখি ভাই,
       বনেতে যাই দোঁহে মিলে।
খাঁচার পাখি বলে-- বনের পাখি, আয়
        খাঁচায় থাকি নিরিবিলে।'
                 বনের পাখি বলে-- "না,
আমি     শিকলে ধরা নাহি দিব।'
        খাঁচার পাখি বলে-- "হায়,
আমি     কেমনে বনে বাহিরিব!'

বনের পাখি গাহে বাহিরে বসি বসি
                 বনের গান ছিল যত,
খাঁচার পাখি পড়ে শিখানো বুলি তার--
                 দোঁহার ভাষা দুইমতো।
বনের  পাখি বলে, খাঁচার পাখি ভাই ,
        বনের গান গাও দিখি।
খাঁচার পাখি বলে, বনের পাখি ভাই,
খাঁচার গান লহো শিখি।
          বনের পাখি বলে-- না,
আমি     শিখানো গান নাহি চাই।'
        খাঁচার পাখি বলে-- "হায়,
আমি     কেমনে বন-গান গাই।'

         বনের পাখি বলে, "আকাশ ঘননীল,
        কোথাও বাধা নাহি তার।'
খাঁচার পাখি বলে, "খাঁচাটি পরিপাটি
        কেমন ঢাকা চারি ধার।
বনের পাখি বলে, "আপনা ছাড়ি দাও
        মেঘের মাঝে একেবারে।'
খাঁচার পাখি বলে, নিরালা সুখকোণে
        বাঁধিয়া রাখো আপনারে!'
        বনের পাখি বলে-- "না,
সেথা     কোথায় উড়িবারে পাই!'
        খাঁচার পাখি বলে-- "হায়,
মেঘে     কোথায় বসিবার ঠাঁই!'

এমনি দুই পাখি দোঁহারে ভালোবাসে
        তবুও কাছে নাহি পায়।
খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে পরশে মুখে মুখে,
        নীরবে চোখে চোখে চায়।
দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে,
        বুঝাতে নারে আপনায়।
দুজনে একা একা ঝাপটি মরে পাখা,
        কাতরে কহে, "কাছে আয়!'
        বনের পাখি বলে--না,
কবে     খাঁচার রুধি দিবে দ্বার।
        খাঁচার পাখি বলে--হায়,
মোর     শকতি নাহি উড়িবার।



Monday, 18 March 2019

কাজি নজরুল ইসলামের কবিতা -- আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে

আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
কাজি নজরুল ইসলাম

আজ     সৃষ্টি সুখের উল্লাসে–

মোর     মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
                আজ     সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।

    আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে -

বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার – ভাঙা কল্লোলে।
                        আসল হাসি, আসল কাঁদন
                        মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে।
            ঐ         রিক্ত বুকের দুখ আসে -
            আজ       সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!


                        আসল উদাস, শ্বসল হুতাশ

                        সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস, ফুললো সাগর দুললো আকাশ ছুটলো বাতাস,
গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিণাক-পাণির শূল আসে!
                        ঐ     ধূমকেতু আর উল্কাতে
                        চায়     সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,

আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে

                        আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

              আজ     হাসল আগুন, শ্বসল ফাগুন,
                        মদন মারে খুন-মাখা তূণ
                        পলাশ অশোক শিমুল ঘায়েল
                        ফাগ লাগে ঐ দিক-বাসে
               গো     দিগ বালিকার পীতবাসে;

আজ     রঙ্গন এলো রক্তপ্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে

                আজ     সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!
                আজ     কপট কোপের তূণ ধরি,
                ঐ       আসল যত সুন্দরী,
    কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউ বা আগুন,
            কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে!
তাদের প্রাণের ‘বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না’ বাণীর বীণা মোর পাশে
            ঐ    তাদের কথা শোনাই তাদের
                    আমার চোখে জল আসে
            আজ   সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!

            আজ     আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর,

                      আসল নিকট, আসল সুদূর
                      আসল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন
                      পাগলা-গাজন-উচ্ছ্বাসে!
             ঐ      আসল আশিন শিউলি শিথিল
                      হাসল শিশির দুবঘাসে
            আজ     সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

            আজ     জাগল সাগর, হাসল মরু

                      কাঁপল ভূধর, কানন তরু
      বিশ্ব-ডুবান আসল তুফান, উছলে উজান
                      ভৈরবীদের গান ভাসে,
মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বামপাশে।

মন ছুটছে গো আজ বল্গাহারা অশ্ব যেন পাগলা সে।

                আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
                আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!!

Saturday, 16 March 2019

কাজি নজরুল ইসলামের কবিতা -- আমার কৈফিয়ৎ

আমার কৈফিয়ৎ
কাজি নজরুল ইসলাম

বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’,
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি!
কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে!
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি?’
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!


কবি-বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে!
বলে, কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাশ ঠেলে’।
পড়ে না ক’ বই, ব’য়ে গেছে ওটা।
কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা।
কেহ বলে, মাটি হ’ল হয়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে!
কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো ফের যেন তুই যাস জেলে!


গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা!
প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’
আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!


মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্‌-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!
‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’


আনকোরা যত নন্‌ভায়োলেন্ট নন্‌-কো’র দলও নন্‌ খুশী।
‘ভায়োরেন্সের ভায়োলিন্‌’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি!
‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে,
‘নয় চর্‌কার গান কেন গা’বে?’
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্‌ফুসি!
স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের আঙ্কুশি!


নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী-বিদ্বেষী!
‘বিলেত ফেরনি?’ প্রবাসী-বন্ধু ক’ন, ‘ এই তব বিদ্যে, ছি!’
ভক্তরা বলে, ‘নবযুগ-রবি!’-
যুগের না হই, হজুগের কবি
বটি ত রে দাদা, আমি মনে ভাবি, আর ক’ষে কষি হৃদ্‌-পেশী,
দু’কানে চশ্‌মা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ’তেছে নিদ্‌ বেশী!


কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুণ্ডু আমিই কি বুঝি তার কিছু?
হাত উঁচু আর হ’ল না ত ভাই, তাই লিখি ক’রে ঘাড় নীচু!
বন্ধু! তোমরা দিলে না ক’ দাম,
রাজ-সরকার রেখেছেন মান!
যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন! আর কিছু
শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?


বন্ধু! তুমি ত দেখেছ আমায় আমার মনের মন্দিরে,
হাড় কালি হ’ল শাসাতে নারিনু তবু পোড়া মন-বন্দীরে!
যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল,
মেরে মেরে তা’রে করিনু বিকল,
তবু যদি কথা শোনে সে পাগল! মানিল না ররি-গান্ধীরে।
হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে’!


আমি বলি, ওরে কথা শোন্‌ ক্ষ্যাপা, দিব্যি আছিস্‌ খোশ্‌-হালে!
প্রায় ‘হাফ’-নেতা হ’য়ে উঠেছিস্‌, এবার এ দাঁও ফস্‌কালে
‘ফুল’-নেতা আর হবিনে যে হায়!
বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায়
গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা! সেই তালে
নিস্‌ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে।


বোঝে না ক’ যে সে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে,
গান শুন সবে ভাবে, ভাবনা কি! দিন যাবে এবে পান খেয়ে!
রবে না ক’ ম্যালেরিয়া মহামারী,
স্বরাজ আসিছে চ’ড়ে জুড়ি-গাড়ী,
চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে।
মাতা কয়, ওরে চুপ্‌ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্‌ চেয়ে!


ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,
বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।
কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!
কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন
কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?

আমরা ত জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস!
কত শত কোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস
এল কোটি টাকা, এল না স্বরাজ!
টাকা দিতে নারে ভুখারি সমাজ।
মা’র বুক হ’তে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস!
হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ!


বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!


পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথার উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!

কাজি নজরুল ইসলামের কবিতা -- লিচুচোর

লিচুচোর
কাজি নজরুল ইসলাম

বাবুদের তাল-পুকুরে

হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাঁড়া।

পুকুরের ঐ কাছে না

লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে 
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গো যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,

ও বাবা মড়াত করে

পড়েছি সরাত জোরে।
পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই।
ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,
ধুমাধুম গোটা দুচ্চার
দিলে খুব কিল ও ঘুষি
একদম জোরসে ঠুসি।

আমিও বাগিয়ে থাপড়

দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড়
লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল,
দেখি এক ভিটরে শেয়াল!
ও বাবা শেয়াল কোথা
ভেলোটা দাড়িয়ে হোথা
দেখে যেই আঁতকে ওঠা
কুকুরও জুড়লে ছোটা!
আমি কই কম্ম কাবার
কুকুরেই করবে সাবাড়!

‘বাবা গো মা গো’ বলে

পাঁচিলের ফোঁকল গলে
ঢুকি গিয়ে বোসদের ঘরে,
যেন প্রাণ আসলো ধড়ে!

যাব ফের? কান মলি ভাই,

চুরিতে আর যদি যাই!
তবে মোর নামই মিছা!
কুকুরের চামড়া খিঁচা
সেকি ভাই যায় রে ভুলা-
মালীর ঐ পিটুনিগুলা!
কি বলিস? ফের হপ্তা!
তৌবা-নাক খপ্তা!

Monday, 11 March 2019

কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ---ভোর হল দোর খোলো

ভোর হল দোর খোলো
কাজী নজরুল ইসলাম


ভোর হলো দোর খোলো
খুকুমণি ওঠ রে!
ঐ ডাকে যুঁই-শাখে
ফুল-খুকি ছোটরে!

রবি মামা দেয় হামা
গায়ে রাঙা জামা ঐ,
দারোয়ান গায় গান
শোন ঐ, রামা হৈ!' 

ত্যাজি নীড় করে ভিড়
ওড়ে পাখি আকাশে
এন্তার গান তার
ভাসে ভোর বাতাসে।

চুলবুল বুলবুল
শিস্ দেয় পুষ্পে,
এইবার এইবার
খুকুমণি উঠবে!

খুলি হাল তুলি পাল
ঐ তরী চললো,
এইবার এইবার
খুকু চোখ খুললো।

আলসে নয় সে
ওঠে রোজ সকালে
রোজ তাই চাঁদা ভাই
টিপ দেয় কপালে। 

উঠলো ছুটলো ওই
খোকা খুকি সব,
''উঠেছে আগে কে''
ঐ শোনো কলরব।
নাই রাত মুখ হাত
ধোও, খুকু জাগো রে!
জয়গানে ভগবানে
তুষি' বর মাগো রে। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা --- হিমালয় ও হরগৌরী

হিমালয় ও হরগৌরী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হে হিমাদ্রি , দেবতাত্মা , শৈলে শৈলে আজিও তোমার
অভেদাঙ্গ হরগৌরী আপনারে যেন বারংবার
শৃঙ্গে শৃঙ্গে বিস্তারিয়া ধরিছেন বিচিত্র মূরতি !
ওই হেরি ধ্যানাসনে নিত্যকাল স্তব্ধ পশুপতি ,
দুর্গম দুঃসহ মৌন ; জটাপুঞ্জ তুষার সংঘাত
নিঃশব্দে গ্রহণ করে উদয়াস্ত রবিরশ্মিপাত
পূজাস্বর্ণ পদ্মদল , কঠিন প্রস্তর কলেবর
মহান-দরিদ্র , রিক্ত , আভরণহীন দিগম্বর ।
হের তাঁরে , অঙ্গে অঙ্গে এ কি লীলা করেছে বেষ্টন
--- মৌনেরে ঘিরিছে গান , স্তব্ধেরে করেছে আলিঙ্গন
সফেন চঞ্চল নৃত্য , রিক্ত কঠিনেরে ওই চুমে
কোমল শ্যামল শোভা নিত্যনব পল্লবে কুসুমে
ছায়া রৌদ্রে মেঘের খেলায় ! গিরিশের রয়েছেন ঘিরি
পার্বতী মধুর ছবি তব শৈলগৃহে হিমগিরি ।

Thursday, 7 March 2019

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা --- তালগাছ

তালগাছ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



তালগাছ                   এক পায়ে দাঁড়িয়ে
                  সব গাছ ছাড়িয়ে
                             উঁকি মারে আকাশে।
মনে সাধ,              কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়
                   একেবারে উড়ে যায়;
                             কোথা পাবে পাখা সে?

তাই তো সে    ঠিক তার মাথাতে
                   গোল গোল পাতাতে
                             ইচ্ছাটি মেলে' তার,--
   মনে মনে              ভাবে, বুঝি ডানা এই,
                   উড়ে যেতে মানা নেই
                             বাসাখানি ফেলে তার।

সারাদিন                   ঝরঝর থত্থর
                   কাঁপে পাতা-পত্তর,
                             ওড়ে যেন ভাবে ও,
মনে মনে              আকাশেতে বেড়িয়ে
                   তারাদের এড়িয়ে
                             যেন কোথা যাবে ও।

তার পরে              হাওয়া যেই নেমে যায়,
                   পাতা-কাঁপা থেমে যায়,
                             ফেরে তার মনটি
যেই ভাবে,      মা যে হয় মাটি তার
                   ভালো লাগে আরবার
                             পৃথিবীর কোণটি।     

Wednesday, 6 March 2019

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা --- গৌতম প্রয়ান

গৌতম প্রয়ান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এবার চলিনু তবে ।

সময় হয়েছে নিকট , এখন
বাঁধন ছিঁড়িতে হবে ,
উচ্ছল জল করে ছলছল ,
জাগিয়া উঠিছে কলকোলাহল ,
তরনী - পতাকা চল-চঞ্চল
কাঁপিছে অধীর রবে ।

সময় হয়েছে নিকট , এখন

বাঁধন ছিড়িতে হবে ।

আমি নিষ্ঠুর কঠিন কঠোর ,
নির্মম আমি আজি ,
আর দেরি নাই ভৈরব-ভেরী
বাহিরে উঠিছে বাজি ।
তুমি ঘুমাইছ নিলীম নয়নে ,
কাঁপিয়া উঠিছ বিরহ-স্বপনে ,
প্রভাতে জাগিয়া শূণ্য নয়নে
কাঁদিয়া চাহিয়া রবে ।
সময় হয়েছে নিকট , এখন
বাঁধন ছিড়িতে হবে ।


অরুন তোমার তরুন অধর

করুন তোমার আঁখি
অমিয়-রচন সোহাগ-বচন
অনেক রয়েছে বাকি ।
পাখি উড়ে যাবে সাগরের পার ,
সুখময় নীড় পড়ে রবে তার ,
মহাকাশ হতে ওই বারে বারে
আমারে ডাকিছে সবে ।
সময় হয়েছে নিকট , এখন
বাঁধন ছিড়িতে হবে ।


বিশ্বজগৎ আমারে মাগিলে

কে মোর আত্ম পর
আমার বিধাতা আমাতে জাগিলে
কোথায় আমার ঘর ।
কিসেরি বা সুখ , ক'দিনের প্রাণ ?
ওই উঠিয়াছে সংগ্রাম গান ,
অমর মরণ রক্ত চরণ
নাচিছে সগৌরবে ।
সময় হয়েছে নিকট , এখন
বাঁধন ছিড়িতে হবে ।

Tuesday, 5 March 2019

যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কবিতা --- কাজলা দিদি

কাজলা দিদি
যতীন্দ্রমোহন বাগচী


বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই
মাগো, আমার শোলোক-বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুর ধারে, নেবুর তলে 

থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে,
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, একলা জেগে রই;
মাগো, আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?

সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে নাহি ডাকো,
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?
খাবার খেতে আসি যখন 

দিদি বলে ডাকি, তখন
ও-ঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো,
আমি ডাকি, - তুমি কেন চুপটি করে থাকো?

বল মা, দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে?
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল-বিয়ে হবে!
দিদির মতন ফাঁকি দিয়ে 

আমিও যদি লুকোই গিয়ে-
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে?
আমিও নাই দিদিও নাই কেমন মজা হবে!

ভুঁইচাঁপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল,
মাড়াস নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল;
ডালিম গাছের ডালের ফাঁকে 

বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে,
দিস না তারে উড়িয়ে মা গো, ছিঁড়তে গিয়ে ফল;
দিদি এসে শুনবে যখন, বলবে কী মা বল!

বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই
এমন সময়, মাগো, আমার কাজলা দিদি কই?
বেড়ার ধারে, পুকুর পাড়ে

ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোঁপে-ঝাড়ে;
নেবুর গন্ধে ঘুম আসে না- তাইতো জেগে রই;
রাত হলো যে, মাগো, আমার কাজলা দিদি কই?

Friday, 1 March 2019

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা --- কাগজের নৌকা

কাগজের নৌকা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছুটি হলে রোজ ভাসাই জলে 
কাগজ-নৌকাখানি। 
লিখে রাখি তাতে আপনার নাম,
লিখি আমাদের বাড়ি কোন গ্রাম 
বড়ো বড়ো ক'রে মোটা অক্ষরে 
যতনে লাইন টানি। 
যদি সে নৌকা আর-কোনো দেশে 
আর-কারো হাতে পড়ে গিয়ে শেষে 
আমার লিখন পড়িয়া তখন 
বুঝিবে সে অনুমানি 
কার কাছ হতে ভেসে এল স্রোতে  
কাগজ-নৌকাখানি ।।

আমার নৌকা সাজাই যতনে 

শিউলি বকুলে ভরি। 

বাড়ির বাগানে গাছের তলায় 
ছেয়ে থাকে ফুল সকাল বেলায়, 
শিশিরের জল করে ঝলমল্‌ 
প্রভাতের আলো পড়ি। 
সেই কুসুমের অতি ছোটো বোঝা 
কোন্‌ দিক-পানে চলে যায় সোজা, 
বেলাশেষে যদি পার হয়ে নদী 
ঠেকে কোনোখানে যেয়ে -
প্রভাতের ফুল সাঁঝে পাবে কূল 
কাগজের তরী বেয়ে ।।


আমার নৌকা ভাসাইয়া জলে 

চেয়ে থাকি বসি তীরে। 

ছোটো ছোটো ঢেউ উঠে আর পড়ে, 
রবির কিরণে ঝিকিমিকি করে, 
আকাশেতে পাখি চলে যায় ডাকি, 
বায়ু বহে ধীরে ধীরে । 
গগনের তলে মেঘ ভাসে কত 
আমারি সে ছোটো নৌকার মতো - 
কে ভাসালে তায়, কোথা ভেসে যায়, 
কোন দেশে গিয়ে লাগে। 
ঐ মেঘ আর তরণী আমার 
কে যাবে কাহার আগে ।।


বেলা হলে শেষে বাড়ি থেকে এসে 

নিয়ে যায় মোরে টানি 

আমি ঘরে ফিরি, থাকি কোনে মিশি, 
যেথা কাটে দিন সেথা কাটে নিশি, 
কোথা কোন্‌ গাঁয় ভেসে চলে যায় 
আমার নৌকাখানি । 
কোন্‌ পথে যাবে কিছু নাই জানা, 
কেহ তারে কভু নাহি করে মানা, 
ধ'রে নাহি রাখে, ফিরে নাহি ডাকে - 
ধায় নব নব দেশে। 
কাগজের তরী, তারি 'পরে চড়ি 
মন যায় ভেসে ভেসে ।।


রাত হয়ে আসে, শুই বিছানায়, 

মুখ ঢাকি দুই হাতে - 

চোখ বুঁজে ভাবি এমন আঁধার, 
কালী দিয়ে ঢালা নদীর দুধার - 
তারি মাঝখানে কোথায় কে জানে 
নৌকা চলেছে রাতে। 
আকাশের তারা মিটি মিটি করে, 
শিয়াল ডাকিছে প্রহরে প্রহরে, 
তরীখানি বুঝি ঘর খুঁজি খুঁজি 
তীরে তীরে ফিরে ভাসি। 
ঘুম লয়ে সাথে চড়েছে তাহাতে 
ঘুম-পাড়ানিয়া মাসি ।।